বসন্তের ঘরবাড়ি
অমিতকুমার বিশ্বাস
অচেনা যাত্রী
Basanter Gharbari
A collection of Bengali
Flash Fictions by
Amitkumar Biswas
Rs. 30/-
গ্রন্থস্বত্ব: লেখক
প্রকাশ: অনলাইন: শ্রাবণ ১৪২১
(আগস্ট ২০১৪)
প্রকাশক:
‘অচেনা
যাত্রী’র পক্ষে সুমনা বৈরাগীবিশ্বাস, ‘অখিল-স্মৃতি’ গ্রন্থাগার, নিত্যানন্দমনোরমা ভবন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু
সরণি, সুভাষনগর, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, পিনকোড-৭৪৩২৩৫
ইমেল: achenayatri@gmail.com
ওয়েবসাইটঃ www.achenayatri.
blogspot.com
মুঠোফোন:
+৯১ ৮১৫৯০৯৩৭১০
প্রচ্ছদ:
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
অক্ষরবিন্যাস: কুমারেশ পাত্র ও রুপাই
পান্তি
মুদ্রণ: আর ডি কম্পিউটার,চাকদা রোড, বনগাঁ
লেখকের অগ্রজ গ্রন্থ: রাত্রির
হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়োপোকা (গল্পগ্রন্থ)
উৎসর্গ
সূচি
বসন্তের ঘরবাড়ি, ওয়েটিং ফর, অন্তঃসত্ত্বা, মেঘ আর একলা রোদ্দুর, দ্য পেট, জানালায় বৃষ্টি, স্বপ্নের লুকোচুরি, রাধা, বাঁশি, রাধাচূড়া, লেফাফার অশ্রুডানা, রং, রিজারেকশান,
কমিটমেন্ট, খোককস, ডুব-, দাঁড়াশ, কফিনের ’পরে নীল মোম, রাত, পিচবোর্ড, একটি প্রেমের মৃত্যু, যাপন, কোলাজ, ডিভোর্স, উড়ন্ত স্বপ্নের ছাই, একটি পোস্টমডার্ন রবারি ও
কয়েকটি সম্ভাবনাময় কাক, হ্যালুসিনেশান কিংবা আস্তিনে
লুকোনো লালপিঁপড়ে, মাধবীলতা, মার্চ ইন দ্য হেল, মেঘ-বৃষ্টির উপাখ্যান, ফসিল, অলৌকিক
নীল হাত এবং, ফেরা।
বসন্তের
ঘরবাড়ি
তাঁর চোখে ছিল জোছনার
মায়াভরা মেঘপুঞ্জ। ঠোঁটে
মৃদু ঢেউ। সে হাসলেই ভোর
হত, আর
হাঁটলে ঝাউবনে বইত ঝোড়ো বাতাস। সে বাতাসে পাল ছিঁড়ে যায় আচম্বিতে। অগত্যা
আমার নৌকাখানি টলমল।
সেদিন ডাকল সে। গোপনে। কম্পিত স্বপ্নিল হৃদয়ে এগিয়ে
যাই। যেন
অনেক অনেক দিন পর সবুজ ফলের অম্লতা ঘুচে যায়
কাঁচামিঠে রোদের আদরে। অবশেষে ভিখারির মতো হাত উপুড় করে দেওয়া।
দেখি তার উপরে ফড়িংয়ের মতো সহসা এসে বসে করেকটি বাসি লেফাফা। সে বলে, ‘ভাইকে দেবেন’!
ঝড়ের পর চোখ মেলে চাই। দেখি
ঝরঝরে বাইসাইকেল নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে উৎসব। মাঝে এক নির্বাক নদী। আর
তার এপার-ওপারে নিঃশব্দে ভেঙে পড়ছে
বসন্তের সকল ঘরবাড়ি।
ওয়েটিং ফর...
সে নেই। তবে আসবে। কুহু
তো তাই বলে গেল। আরও বলল, “থেকে যান। ও
ফিরবে। আজ, কাল কিংবা পরশু। স্নান
সেরে খেয়ে নিন।”
বাথটাবে বসে সাবানের দিকে
চোখ রাখে অভিধান। ব্যবহৃত। এক
বা দু'বার। এটা
তাঁর। সে
জানে। স্নানাগার
অদ্ভুত এক মায়াময় ঘ্রাণে আচ্ছন্ন। সে ঘ্রাণে পাকা ধানের মতো ঘুম আসে। হাত
বাড়ায় সে। অজান্তে। ছোঁয়। ছুঁয়ে ফেলে
হৃৎকুসুম। যেন
পুলক লেগেছে ঘাসবনে। যেন গাঢ় শীতে জোনাকির পালকে
লেগেছে মেঠোআগুন। এভাবে
আজ কাল পরশু। কাটে। কেটে
যায়। তবু
অপেক্ষা। কাল
আসবে। হয়তো। আর
কত? কত
দিন? কত
রাত? কত
পথ? এদিকে
সাবানের মতো ক্রমশ ক্ষয়ে আসে স্বপ্নের শরীর!
অন্তঃসত্ত্বা
কী যেন নাম তাঁর? চাঁদচাঁদ? হয়তো। সে
এল। কয়েক
দিনের জন্য। ক’টা মাস হবে। ক’টা বছর বা যুগও হতে পারে। তাকে
ঘিরেই আমাদের কাজ। অবশ্যই
প্রাতিষ্ঠানিক। স্বপ্নও। সেটা
অবশ্য...
ঋজু, নিলয় আর আমি। সে
তখন অন্তঃসত্ত্বা। আরও কয়েকদিন। এভাবেই। আমাদের কাজ এগোয়। স্বপ্নও। চাঁদ
আসে। চাঁদ
যায়। আমরা
জোছনায় যে-যার মতো ডুবে যাই। স্নান
করি। সাঁতার
দিই। পেঁজা
পেঁজা তুলোর মতো সে জোছনা। তারপর সময় হল। কৃষ্ণপক্ষের। সে চলে যায়।
দেখি আমরাই অন্তঃসত্ত্বা!
মেঘ আর একলা রোদ্দুর
কালো মেয়ের পাত্র হল না
আজও। তাঁর
স্বপ্নে ডোবানো বিস্কুট একটু একটু করে ক্ষয়ে আসে। নীল নীল স্বপ্ন। মেঘের
আড়ালে লুকিয়ে থেকে ফুলের সাথে খেলা করার সুদীর্ঘ স্বপ্ন।
সে সুন্দর, মেঘ আর কাঁচা মাটির মতোই। স্বপ্নও। সে
এলেই গাছে গাছে ফুল আসে, ডালে
ডালে পাখি। নৌকায়
পাল তুলে দিলে যেমন রূপসি হয় রূপসা, তেমনই সে! আর তাঁর কিশোরী মেঘের মতো
অভিমান, যেন
কামরাঙা হয়ে আছে সারাটা বিকেল। তবু...
সে আজও বসে আছে। দাওয়ায়। একা
একা। একদিন
ভীষণ মেঘ করবে। একদিন
মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। একদিন। হয়তো। তখন ভিজে যাবে স্বপ্নের
অগোছালো রোদ্দুর!
দ্য
পেট
সাইকেলটা পড়েই ছিল। পাশে। অনেকক্ষণ। ঠিক
মনে নেই—আধ ঘন্টা হতে
পারে, আবার
হতে পারে আট। কেবল
ধোঁয়া উড়ছে। একটার
পর একটা। মোবাইলটাও
নির্বাক। ঘুম
ঘুম ভাব। ঘুমে
জেগে ওঠে সাইকেলের হৃদয়। ঘোড়ার মতো ছোটে। সৈকত বরাবর। টগবগ
টগবগ। নৌকা
এখনও দাঁড়িয়ে। ঝড়
উঠেছে। খুব। টলমল
তরী। তবু...
না। সে এল না। অগত্যা
ফেরার পালা। ডানাছেঁড়া
ফড়িংয়ের মতোই। সাইকেলটাও
চলে। খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে। পোশা
কুকুর কিংবা বিশ্বস্ত হতাশার মতোই।
জানালায় বৃষ্টি
হঠাৎ বৃষ্টি। এমনটা
আশা করেনি সাগ্নিক। বন্ধ
জানলার পাশে আশ্রয়ে কিছুক্ষণ। সামনে খেলার মাঠ। সেথা কচিকাঁচাদের লাফালাফি। এক
সময় জানলাটা খুলে গেল।
--সো-ম- মু- মু- মু -মু- মু- উ- উ- উ !
চোখ যায় সেদিকেই। চোখাচোখি। চোখে
হারিয়ে যাওয়া। অনেক
অনেক দিন পর। আবার। এভাবেই। পুকুরের
রাজহাঁসগুলো কেমন লাফিয়ে ওঠে জলে। ডানায় তখন অজানা পালকের পুলক। সুমন
দৌড়ে ঘরে ঢোকে। বৃষ্টিও
থেমে আসে। বন্ধ
হয় জানালা কিংবা দরজা।
স্বপ্নের
লুকোচুরি
আমার মৃত্যু হেঁটে আসছে। আমার জীবনও। এভাবে। একা
একা। পায়ে
নূপুর পরে। এই ভর দুপুরে? কী আশ্চর্য! আমি কি ডুবে
যাব, বনানী? শুনতে পাচ্ছ? মেঘের থেকেও সুন্দর এখনও
কি কেউ একজন ভীষণ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে! এপারে? ওপারে? তবে কি তুমিই? এত বছর পরে? না না। এ
আমার ভুল। তুমি
তো পায়ে কখনো নূপুর পরো না! তবে?
মন খারাপের পাখি ঘুমিয়ে পড়ে। চুপিচুপি। নূপুরের শব্দও মিশে যায় গাঢ়
নীলরঙা দুপুরে। আমিও ।
রাধা
তুই এলেই আমার ঘরে
শিমুল-পলাশেরা কথাবলে। চুপিচুপি এ-ওর দিকে চায়। এক মায়াবী ঘ্রাণ খেলা করে ঘরময়। তুই চোখ তুলে চাস। দেবীর মতো। অকস্মাৎ। আমি নির্বাক।
সেই কবে থেকে। এরকম। কুড়ি, তিরিশ কিংবা তারও বেশি বোধহয়। তখন থেকেই। আমি। নির্বাক ছবি। এখনও তোর চুলে জোছনার তুলতুলে ঘ্রাণ। ঠোঁটে প্রাচীন ভালোবাসার মতো
আলোছায়া। ঘটি থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। সারাটা ঘর ভেসে যায়। কার খেয়াল আছে সেদিকে?
কেন তুই আসিস? কার কাছেই-বা আসিস? এসব তো ভাবিনি! শুধু ভাবি
তুই আসিস। বাতাসের মতো রং নিয়ে। আবার চলেও যাস। কোথায়? সেখানেও কি আমার মতো আমি ঘুরে বেড়াই নিজেকে না বলে? তোর ঘ্রাণমাখা পথে? আমি আমি আর আমি! একা একা!
সময়ের
চুলে পাক ধরে। তবু তুই আসিস। চলে যাস। রোজকারের মতো।
বাঁশি
ঝরাপাতার আবেগের মতো তোয়া
পাশ ফেরে। থামে। হঠাৎ। একটা দীর্ঘ হতাশ্বাস এসে ঠেকে পিঠে। অগত্যা পাশবালিশকে আরও একটু জড়িয়ে ধরা। এরপর উঠে পড়ে। জানলার ধারে। জোছনার নীল শ্রাবণে এক অসম্পূর্ণ গান নদীর মতো
ভেসে যায় একাকী। পাশে এক মৃতপ্রায় নগরী
হারিয়ে যায় অসহায় বাতাসে। বালুকণায় লেগে থাকে লাল-নীল-হলুদের উপাখ্যান। চিকচিক করে। অন্তঃসত্ত্বা মেঘের মতো। বাঁশি বাজে। দূরে। বহুদূরে। বাঁশির বিছানায়। তোয়া কান পাতে। আরো। আরো। আরো।
ভোর হয়ে আসে। তোয়া ফিরে যায়। পাশবালিশের নরম শরীরে ডুবে
যায় একটা নৌকার হৃদয়।
রাধাচূড়া
কালো মেয়ের বুকেও প্রেম আসে
জানা ছিল না। তুই আসলেই মেয়েটা গুনগুন
করে গান ধরে, যেন
বলতে চায়, ‘আমি তো তোমার রাধাগো, আর তুমি আমার কৃষ্ণ। গত জন্মের বিপরীতে হাঁটছি এখন।’ মেয়েটা গেয়েই চলে। গুনগুন গুনগুন। বর্ষার তালে তালে। শরতের শিউলি ঝরার
ফাঁকে ফাঁকে। শীতের কুয়াশা ভেজা সকালে। বসন্তের অরণ্যে। গুনগুন গুনগুন। তবু তুই মৌন। বাঁশি ধরিস না। পুকুর পাড়ে যাস না। চোখের দিকেও ঠিকঠাক চেয়ে
দেখিস কি না সন্দেহ। তবু প্রেম থেমে থাকে না। চোখে-মুখে-বুকে। ফল্গুনদীর মতো বয়ে চলে চিরকাল।
তুই বিয়ে করলি। চাঁদের মতো এক পরী এল ঘরে। আর সেই মেয়েটা সারারাত খুব কাঁদল, জানিস!
সেই শেষ। তারপর আর কোনোদিন শোনা যায়নি
তার গান। তার কান্নাও। জানা যায়নি কিছুই। জানার যে প্রয়োজন পড়েনি কারোও!
লেফাফার অশ্রুডানা
চললাম। মরতে নয়। গড়তে। নিজেকে। কি লাভ? লোকে হাসবে! তুমি বরং ভালো থেকো। নতুন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে। আমিও থাকব। আধভাঙা চাঁদ আর বুজে আসা
ডোবা নিয়ে। স্মৃতির পাখিদের দানা দিতে
দিতেই কাটিয়ে দেব সারাটা বিকেল!
দুই
উত্তর পেলাম না। পাব না জানতাম। আজও আছ। এটাই সুখের। আমিও। আমাদের জীবনে দ্বিতীয় থেকে
তৃতীয়রা দোল খাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়। তবু স্মৃতিতে লুডো খেলে যায় কামরাঙার
মতো ভালোবাসা। তাই...
তিন
এখনও আছ। আছি আমিও। তৃতীয়-প্রজন্ম নিয়ে। আহা, চুলে একটু রং দিও!
আজও যে চেয়ে থাকি কাঁচামিঠে রোদের দিকে !
রং
সে আর ফেরেনি। যদিও অনেক দিন হল। ছোটু এখন হাঁটতে পারে। ‘মা’ ‘মা’ বলতে পারে। বাতাসে শিমুল-পলাশের মায়া এল। তবু অপেক্ষা। হয়তো গ্রামপথের ধুলো ওড়াতে ওড়াতে আসবে সে। আবিরে আবিরে ভরে যাবে গোটা
এলাকা। লোকজন ছুটে আসবে ঘরবাড়ি
থেকে।
নুনি দাওয়ায় বসে। রং-এর দিন এল। পান্নার পড়ে থাকা পিচকারি হাতে নিয়ে ছোটু
খেলছিল। সামান্য গোলা রং পড়ে আছে তাতে। নিষ্পাপ হাতের চাপে বেরিয়ে
আসে সে-রং, আর চট
করে একটু
খানি লেগে যায় নুনির মুখে। ঠোঁটে। অমনি
ছোটুকে জড়িয়ে ধরে তুমুল ভাবে!
মেঘ করেছিল। এবারে বৃষ্টি ঝরতে থাকে
অঝোরে।
রিজারেকশান
অনির্বাণ রতনপুর ফিরে এল
প্রায় দু-দশক পর। যশোদার চোখে ছানি। তবু স্নেহের ঘ্রাণে বৃষ্টি
নেমে এল দু-চোখে। বহুদিন
পর।
পাশের বাড়িতেও ছানি। পা রাখতেই নেপথ্যে বাঁশি
বেজে ওঠে। ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা
সুখ-অসুখের অতীত উঠে এল। শ্রাবণ এল। ঝুলন এল। রাধাকৃষ্ণ
সাজার
পালা এল। গোপিনিরা এল। যমুনা এল। ঢেউ এল। সব সব উঠে এল এক করে। যেন করোটির গভীর গহিনে নেমে ইতঃস্তত হামাগুড়ি দিচ্ছে
স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা।
হঠাৎ ঝমঝমিয়ে
বৃষ্টি। ছানিপড়া বাড়ির আশ্রয়ে
অনির্বাণ। শ্রাবণসুরে ভিজে গেল
ঝোপঝাড়। দোলনা। রাধাকৃষ্ণ। গোপিনিরা। যমুনার কিশোরী বুকে নামছে জলের ধারা। অবিরাম।
বৃষ্টি থামে। নৈশঃব্দ্যের মধ্যে হেঁটে
যায় রাধা। পেছনে কৃষ্ণ। নেপথ্যে বাঁশি।
কমিটমেন্ট
সবে
একটা। মোবাইলটা টেবিলে রেখেই
বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিল শ্রীলা। ফিরে আসে মিনিট দশেক পর। এর মধ্যেই সাত-সাতটা মিসড্ কল। তিনটে মেসেজ।
এক, ‘Happy
Anniversary Mrs Som.’
দুই,
‘Why so late?’
তিন, ‘Coming
in the late afternoon, darling.’
শেষেরটা
সুজিতের। রাতে পার্টি। তাই খুব চাপ। কল ব্যাক করে।
-হ্যালো।
অপর প্রান্তে কোনো কথা নেই। মুখে একটা বিরক্তিভাব শ্রীলার। ঝটপট লেখে, ‘Coming
within an hour.’ সেন্ট হল। তোয়ালে সরিয়ে নাইটিটা গলিয়ে নেয়। এ-সময় দুষ্টু ঘরখানি চোখ মেলে দেখে নেয় পলাশবনে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে-আসা পাখিদের আদর আর এলোমেলো পান্ডুলিপির অবিরাম সন্তরণ।
নিজেকে এলিয়ে দেয় সোফায়। হাতে রিমোট। টিভিতে ঠান্ডা পানীয়র
বিজ্ঞাপনে এক নব্য ভারতরত্ন। চেঞ্জ। সিরিয়াল। সিনেমা। ক্রিকেট। ফিক্সড্। সব ফিক্সড্। পাতা ওলটানোর মতো এগিয়ে যায় টিভিতে। সহসা ডোরবেল বাজে। টিভির পরদা থেকে চোখ সরে। দরজা খোলে। একজন ঢোকে। বসে। চা খায়। হাত দুটো এগিয়ে দেয়। পিছিয়ে নেয়। আবার চলেও যায়। শ্রীলা আবার ফ্রেশ হতে ছোটে। টেবিলে তখন ফোনটা কেঁপে ওঠে। দু’বার। একাকী।
খোককস
সবচেয়ে উঁচু গম্বুজের উপর
দিয়ে ভেসে যাওয়া একটা ঝোড়ো চুম্বন শুধু
তোমার জন্য। শুধু...শুধু... তোমারই
জন্যই দ্যাখো এতদূর হেঁটে আসা। একটা বন একটা রাত একটা
ঝড়ের রাত হেঁটে আসা। শুধু...শুধু তোমারই জন্য!
সহসা হাত থেকে পড়ে গেল! একটা কবিতা? একটা আত্মা? একটা চুম্বন? একটা...একটা...? কী ? কী?
তোমায় দেখি। নৃত্যরত। ময়ূরের সাথে। এই নববর্ষায়। আর তোমার বিশাল চুম্বন
ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছে বৃষ্টির পেটে।
ডুব
চাঁদ ডুবে গেল। তবু চাঁদ জেগে। ব্যালকনিতে। একা। বড্ড একা।
দুই
রোহিতের নম্বরটা ডিলিট করে
দেয়। কি হবে রেখে? তার আগে একটা মেসেজ। ভালো থেকো। চলি। ইত্যাদি।
তিন
এবারে সেও ডুব দেয়। ডু-উ-উ-উ-উ-উ-উ-উ-উ-উ--উ-ব!
দাড়াঁশ
শরৎ এসে গেল। অথচ চড়া রোদ ভুলুকে
কিছুতেই ছুঁতে পারে না। সারাদিন বেচারা কুঁই কুঁই করে কেঁদে বেড়ায়। এ কৃতিত্ব নির্মলের। প্রকৃতপক্ষে বোস বাড়ির
নির্মল পরিবেশের জন্য তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবু এক গোপন হাহাকার ভেসে বেড়ায়
অন্দরমহলে। শ্রীলেখা আজ সাফ জানিয়ে
দিল, “ডাক্তার দেখাও, নয়তো আমাকে মুক্তি দাও। সুমিকে নিয়ে আমি কোথাও চলে যাই। এভাবে আর কত দিন!”
অতএব চেম্বারে। ডাক্তার অনেকক্ষণ চেক-আপের পর এক দীর্ঘশ্বাস
ছেড়ে বললেন, “ইরেকশান ডিসফাংশান! কিউরেবেল। বাট টেক আ টাইম।” এ-ওঁর মুখ চায়। আবার ফিরিয়ে
নেয়। অবশেষে পরাজিত সৈনিকের মতো ঘরে ফেরা।
দুই
গভীর রাত। চাঁদ আজ বড়ো বেশি একা। ভুলু শুয়ে একপাশে। শুয়ে শুয়েই কুঁই কুঁই। ভুলুর কান্নাটা সমস্থ হৃদয়কে তছনছ করে দেয়। নীচে নেমে আসে নির্মল। ধীরে ধীরে। ভুলুর পাশে আসে। বসে। জড়িয়ে ধরে তাকে। অবশেষে বাঁধ ভাঙে। জলের তোড়ে ভেসে যায় সব!
কফিনের ’পরে নীল মোম
যেন দু-জনমের মাঝে আটকে থাকা
এসকেলেটরে দাঁড়িয়ে বিলকিস। মুখের রোদ সরে সরে যাচ্ছে। ক্রমশ। এই অবেলায়। বিকল-বাতাসে নৌকার পালের মতো নিষ্পলক তাঁর দৃষ্টি। শরীর নুয়ে পড়ছে বটের শাখার মতো। স্মার্টফোনে আঙুল বুলিয়ে
দেখে নিল অবস্থান। কী আশ্চর্য! ভুল।ভুল ভুল। সে ভুলের উপর দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। অথচ সমীরণই বলেছিল MARK HOTEL–এর সামনেই দেখা
হবে। তার মানে সে ‘Unmarked’! রোদ
চশমাটা খুলতেই এক ঝাঁক ঝাঁঝালো তেতো রোদ এসে লাগে। এ রোদের বুক চিড়ে রহস্যময় মানুষের মতো
কেউ একজন এগিয়ে আসে। বলে,
-আপনিই বিলকিস?
-হ্যাঁ! কেন?
-সমীরণ পাঠালেন। এই নিন।
লোকটা উধাও। আর সে বিলম্বিত বিষ্ময়ে একা দাঁড়িয়ে। পা-দুটো ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে চোরাবালির ক্ষুধার্ত পেটে। শূন্যের দিকে কেবলই চেয়ে থাকে ফ্যাল ফ্যাল করে। কয়েক ফোঁটা তরল মুক্তোর শরীর ছুঁয়ে যায় পাগল বাতাস, আর সে বাতাসে ভেঙে পড়ে বসন্তের সকল ঘরবাড়ি!
রাত
চাঁদ আমাদের দেখে লুকিয়েছিল
মুখ। পাতার পিছনে। আর আমিও তাকে দেখছি। লুকিয়ে। সে ওড়না মুখে দিয়ে মুচকি
হেসে বলল, “কেন আসেন এই অবেলায়?”
-কেন
আসি? সে-তো
জানি না। ভাবিনি কখনও ! শুধু জানি
আসি। আসবো। এভাবেই। আর তাকিয়ে থাকব তোমার নীলচোখ
দুটির প্রতি। অনন্ত কাল। অনন্ত তারার আলো মেখে।
পিচবোর্ড
লোকগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে
ছিল। বলা হল ওদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হবে, কারণ ওদের
বাপ-ঠাকুরদারাই গুলি চালিয়েছিল। কেউ কেউ বলল, না, টাইম বোমা বেঁধে
ছেড়ে দেওয়া হোক সমুদ্রে অথবা মরুভূমিতে। কেউ আবার বলল, না, কাঠের গুঁড়ির উপর রেখেই কচুকাটা করা হোক আর টুকরোগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হোক
ঘাসবনে। কেউ বুলেট বা ফাঁসিতে ঝোলানোর পক্ষপাতী। কেউ আবার বলল, তার আগে এদেশের
ভাষাটা শেখানো হোক। তিনমাস লাগবে। কিছু খরচ হবে ঠিকই। কিন্তু এতে একটা মানবিক
আবেদন ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়।
লোকগুলো দাঁড়িয়েই ছিল। ওদের মা-বউ-মেয়েদেরকে আলাদা নিয়ে যাওয়া হল। শিশুদেরকেও।
ইতিমধ্যে ঘোষণাপত্র এল, আরো একশো বছর উদ্বাস্তু শিবিরে রেখে দেওয়া হোক তাদের। এই শুনেও লোকগুলো যখন নড়ছে না, তখন বেয়নেট দিয়ে একটাকে সামান্য টোকা দিতেই অবিকল পিচবোর্ডের মতো পড়ে
গেল মাটিতে। দেখাদেখি বাকিরাও। দেখতে দেখতে সেখানে এক
বিশাল পিচবোর্ডের ঢিবি! একটা শিশু হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এল ঢিবি থেকে। উঠেই সে পিচবোর্ডর স্তন শুষে খায়। পুরোটা খেতে বোধহয় একশো
বছর লেগে যাবে।
একটি প্রেম অথবা নিটোল অবসেশন
এখানে এলেই পৌলমি চুপ হয়ে
যায়। এখান দিয়ে সে আসতে
চায় না। অথচ সৃজাকে স্কুলে দিতে
গেলে তাকে লাইনটা টপকাতেই হয়। নইলে অনেকটা পথ ঘুরে আসা লাগে।
সেদিন গোধূলির ছায়ার নীচে লুকিয়ে রমিত আসবে। সদ্য রেলের গ্রুপ ডি-তে জয়েন করেছে। পৌলমীর বাড়ি থেকে আপত্তি। ভীষণ। তাই দুজনের হারিয়ে যাবার
একটা কঠিন সিদ্ধান্ত। একসাথে।
লোকাল ট্রেনে উড়ছিল রমিত। এবার দুজনে। একসাথে উড়বে। আকাশে। মহাকাশে। চাঁদের চুমু নিয়ে ভেসে
বেড়াবে এসপার-ওসপার। আর একটু পর।
হল না। পাখির সকল ওড়াউড়ি থেমে গেল। একেবারে।
দ্রুতপায়ে এগোতে থাকে পৌলমি। খুঁটিটাকে ছুঁয়ে ফেললে আজ
নিজেকে সামলানো কঠিন!
যাপন
সুনসান রাস্তার একপাশে গাড়ি
রেখে ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে গেল লোকটা। সন্ধ্যায় আর-একজন। রাতে আর একজন। এভাবে দূরের লোকটা খুঁজে
পায় প্লাস্টিকের গোলাপ ও কুচো পেঁয়াজ মেশানো মুড়ির মুচমুচে স্বাদ। ভোরবেলা গাড়ি নড়েচড়ে বসে। হারিয়ে যায়। ছুটন্ত গাড়ি আর রাতের সুতীব্র নেশা। ঝুপড়িতে তিনটে
কাচ্চাবাচ্চা ন্যাংটো হয়ে খেলে বেড়ায় সারাদিন। একজন রান্না করে। খেত থেকে তুলে আনে সবজি। ইতিমধ্যে একটা নীল রঙের গাড়ি এসে
দাঁড়ায়। নতুনই। তাঁর চোখ ছলছল করে ওঠে। একটু দ্রুত এগিয়ে যায়
সেদিকেই।
কোলাজ
পার্লার
-রেডি?
-হ্যাঁ। কন্ডোম হবে?
-হুম! বিশ টাকা এক্সট্রা।
ড্রয়িংরুম
-বাপি আমাকে কলেজগেটে ছেড়ে আসবে!
বেডরুম
-ধুর,বলেছি-না মেয়ে বড় হয়ে
গেছে!
ডিভোর্স
পাখি
ডাকে। জানালায়। রোজ। ভোরে। কাচ ঠোকরায়। আমি দেখি। বসে। একা। রোজ। রোজ পাখি পাখির খোঁজে। আর আমি...
সে তো আজও একা। কাচের ঘরে।
উড়ন্ত স্বপ্নের ছাই
রোজ সেখানে যাই। দরজায় ঠোঁট রাখি। আলতো করে। তারপর শেষ। এভাবেই বিশ বছর। আরও হয়তো কাটবে। এভাবেই। তুমি সাজো রোজ। হয়তো আমার জন্য। আমিও...
আমাদের ঘর ছিল ঘাসবনের এপাশ আর ওপাশে। ঠিক রুপাই-সাজুদের মতো।
ভাবি, এত কঠোর তবে
স্বপ্নও। ওই চুমু খাওয়া পর্যন্ত। আজও তুমি টসটসে চেহারায় কিশোরী। আমি কিশোর। কোনও দিন সময় এগোবে না। কেবল ঠোঁটের ছোঁয়া লেগে থাকবে
দরজায়। চিরকাল। আর আমি জেগে উঠবো
প্রতিরাতে। ঠাণ্ডা ঘামে। পাশের জন তখন ঘুমিয়ে কাদা!
একটি পোস্টমডার্ন রবারি ও কয়েকটি সম্ভাবনাময় কাক
ভিখারিটি
দরজার পাশে ঝিমোচ্ছে। সামনে টিনের কৌটো। টাই-পরা বাবুটি কৌটোয় হাত ঢুকিয়ে বার করে
আনে কয়েকটি কয়েন। দৃশ্যটি দ্যাখে পুলিশ, রামু চা-ওয়ালা ও আমি।
লোকটা সিগারেট ধরায়। আমাকে দেয়। অনেকদিন খাইনি, তাই
দু-টান দিতেই হেব্বি জমে গেলাম। রামুও। ব্যাস। ইতিমধ্যে ভিখারিটা উঠেছে।
পিচুটিচোখে আমাদের দিকে পিটপিট করে চায়। হাত বাড়াতেই টাই-পরা বাবুটি তার দিকে একটা
কয়েন ছুঁড়ে দিলেন।
দুই
ভিখারিটা
মারা গেছে। এলাকায় এভাবে কোনো ভিখারি মারা যায়নি, তাই এখান থেকে সোজা
ক্যাওড়াতলা মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সমবেত উদ্যোগ। আমি হাঁটলাম। সঙ্গে বাবু,
পুলিশ ও রামু। মাঝপথে ভিখারিটা উঠে দাঁড়ায়, চিৎকার করে বলে, ‘আমি মরিনি’! কিন্তু আমরা তা শুনতে যাব কেন? ঘোষক জানিয়েছেন,
সে মরেছে। ব্যাস! সুতরাং মিছিল এগোতে থাকে। ভিখারিটি ভয়ে কেঁদে
ফেলে। লোকজন তাকে উৎসাহ দিয়ে বলে, ‘কোনো টেনশান করবেন না,
চুপচাপ শুয়ে পড়ুন’। এদিকে ক্যাওড়াতলা
এসে দেখি, সে পগারপার! অগত্যা বিড়ম্বনা। প্রশাসনের মাথায়
হাত। পা-ও। বাইরে প্রকাণ্ড ভিড়। এখন কিছু ঘটে গেলে?
হঠাৎ ভিড় থেকে একজন চলে আসে। অবিকল সেই লোক! তাজ্জব! বোধহয়
টলিপাড়া থেকে। প্রশাসনের মুখে চওড়া হাসি। অতএব এবারে চুল্লিতে প্রবেশ। লাইট!
ক্যামেরা! অ্যাকশান!
তিন
চিমনি
দিয়ে বেরিয়ে আসছে হাজার হাজার কাক। চতুর্দিক ঘন কালো হয়ে আসে। কলকাতার সব আলো নিভে
যায় একে একে। এক্ষুনি সটকে পড়তে হবে। কিন্তু কোন দিকে?
হ্যালুসিনেশান কিংবা আস্তিনে লুকোনো লালপিঁপড়ে
তাহলে
সে কে? সিঁড়ি
বেয়ে উঠে আসা এক জোড়া নগ্ন পা আর শরীরে জড়ানো গামছা। অলৌকিক হলুদ আলোয় দূর থেকে
বুঝে নিয়েছে সেই অপ্সরা-আগমন। তাঁর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে জোছনার মতো। যেন পাকা ধানের
হাসি সারা ঘাসবনে। কার? বড়োর, মেঝোর,
ছোটোর? কার...কার...? পায়ের পাতার দিকে চেয়ে চেয়ে ক্রমশ খুঁজে চলেছি জলের আলপনা কিংবা নির্জন রাতের
হেঁয়ালি। হয়তো এবারে বলে উঠবে, কী দেখছো ঠাকুরপো? হয়তো চোখে চোখ পড়তেই সলজ্জ মুখে চলবে মৃদু হাসি চাপার এক ব্যর্থ প্রয়াস। তবু
এক অনন্ত অন্বেষণ।
দুই
খবরটা
আমাকে মর্মান্তিক ভাবে চমকে দিল।
-তীর্থ তীর্থ!
-কী...?
-সোনামন!!
-কী করেছে সোনামন?
-ঝুলছে! চল তাড়াতাড়ি!
-সেকি! চল!
পড়া
ফেলে ধূমকেতুর মতো ছুটে গেলাম। পিছনের টালির ঘরটায় সোনামন একা থাকে। ঝুলন্ত শরীরটা
নীচে নামালাম। শেষ,
সব শেষ! আমাকে ফেলে একা একা বহুদূর এভাবে পালিয়ে গেল সে!
তিন
অনেক
অনেক বছর পর মায়াপুরের উদ্দেশ্যে তিন বৃদ্ধা। আমিও সাথি। সঙ্গে নিলাম গামছাটা,
লোকে তো পুড়িয়েই ফেলছিল!
চার
হোটেলের ঘরটা শূন্য। পথে
নামলাম। মন্দির, নাটমন্দির-হেথা হোথা। শূন্য, কেবল শূন্য। নদীর কাছে ছুটে যাই, দেখি ঘাটের সিঁড়িতে বসে গামছাটা
বুকে নিয়ে কাঁদছে একজন। কে...? বড়ো? মেঝো?
ছোট...?
মাধবীলতা
প্রবল বৃষ্টি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যুবকটি। হাওয়ায় প্রায় উলটে যাচ্ছে
ছাতাটা। মাধবী সেদিকেই চেয়ে। তাঁর কাছে বৃষ্টি এক
অবসেশন। মাটিতে যেন টপটপ করে রক্ত
ঝরে আজও। আজও কাঁচামাটির গন্ধ লেগে
তাঁর দু’হাতে। অকস্মাৎ
তোয়ার ডাকে সম্বিৎ ফেরে তাঁর।
-ছোটঠাম্মা আসি!
তোয়ার পলাতকা পথের দিকে
তাকিয়ে ছিল সত্তরের মাধবী। অনেক অনেক দিন পর বৃষ্টিকে বড় বেশি ভালো লাগে তাঁর।
তখন সবে সতেরো। সাদা থান পরে পুকুর ঘাটে তাঁর নিত্য আসা- যাওয়া। সেখানে নাসিরের সাথে আলাপ। কালো পেটানো শরীর। চোখে চোখ পড়ে। হাতে হাত। কথাটা কানে যেতেই বাবুদের সামনে
কানধরে উঠবস করতে হয় বেচারাকে।
--কী করে সাহস হল হিঁদুর
মেয়েকে চোরের মতো নৌকা চড়ানোর, তাও আবার চৌধুরী বাড়ির বিধবাকে!
তবু ফুলের সুবাশে এক বৃষ্টির দিনে চুপিচুপি এল সে। বলল, চলো বৌঠান!
--কোথায়?
--যেদিক দু-চোখ যায়!
--তাই চলো।
নাসিরকে তীব্র আলিঙ্গনে
বাঁধে। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে যায়। অমনি মাথার পেছনে 'দুম্ দুম্' লাঠির বাড়ি! জলে ছিটকে পড়ে নাসির, যেন এক শান্ত পাহাড় বুকভরা
অভিমান নিয়ে ভেঙে পড়ে সাগরের জলে। মুহূর্তেই লাল হয়ে ওঠে জলের প্রাণ। আর্তনাদ করে মাধবী। তাঁর পা-দুটি কারা টেনে নিয়ে যাবার সময় ভীষণ
এক মায়ায় সে আঁকড়ে ধরতে চায় নরম কাঁদামাটির শরীর। পারে না। হাতে লেগে থাকে কেবল মাটির তাজা রক্ত।
আজ হঠাৎ কম্পিত হাতে আঁকড়ে ধরতে চায় একমুঠো নীল শূন্যতা। আজও ঠোঁট কাঁপে। আর সে-কম্পনের ফাঁকেই ছড়িরে পড়ে মাধবীলতার ঘ্রাণ। সে ঘ্রাণ পৃথিবী ছাড়িয়ে চলে যায় আলোকবর্ষ দূরে ।
মার্চ ইন দ্য হেল
প্রেমিকা বলল, তোমার মুখে থুঃ!
মা
বলল, তোর মুখে থুঃ!
দেশবাসী
বলল, তোদের মুখে থুঃ!
দুই
আসামী
এগিয়ে এল ফাঁসিমঞ্চে। কালোকাপড় মুখে। হাত বাঁধা। ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। এক একে তার মনে পড়ে সব। শিশুটিকে ছিনিয়ে নিচ্ছে লাল কুকুরগুলো। মায়ের ফসলি স্তনে তখনও তাঁর মুখ। ঝাঁপিয়ে পড়ল কুকুরগুলো। ভাদরের চড়া রোদে পুড়ে গেল মোসানি। মাড়িহীন চোয়ালে লেগে থাকা দুধের সাথে মিশে
যাওয়া কান্না ও লালার মতো চিৎকার ওজোনস্ফিয়ার ভেদ করে ছুঁয়েগেল চাঁদের বক্ষদেশ। তবু...
এমন সময় অ্যালবার্ট গর্জে ওঠে। উর্দিতে কেবলই রক্ত। পড়ে থাকে কুকুরগুলো। দুগ্ধদাত্রী তত সময়ে শেষ। আর শিশুটি লালায় লালায় ভরে গেছে। বুকে তুলে নেয়। জড়িয়ে ধরে। শিশুর মতো শিশুকেই। আর এই অপরাধেই...
রুমাল নড়ে। আর শেষমেশ নিজেকেই নিজে জড়িয়ে থাকে মহাশূন্যে। শান্ত ধ্যানস্থ মুনির মতো।
তিন
কিছুদিন আগে আগুন্ডার ফাঁসি
হয়। সে এক নৃশংস ধর্ষক। তবু মোসানির পথে পথে জ্বলে
উঠেছিল মোমবাতি। “খুনি রাষ্ট্র নিপাত যাও।” বুদ্ধিজীবী শ্রমজীবী সব। আর আজ পথ সুনসান। সবার মুখে কেবল ‘থুঃ’!
চার
মর্গে এগারো বছর পড়ে থাকে অ্যালবার্ট। অবশেষে কিছু কালো কুকুর একদিন অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে সেখানে। টেনে নিয়ে যায় একটা একটা করে হাড়। চিবিয়ে খায়।
পাঁচ
অবশেষে ছাড়পত্র পেয়ে অ্যালবার্ট চলে আসে। দ্যাখে, লাল কুকুর তিনটে বসে আছে। ল্যাজ নাড়ছে। পাশে স্বয়ং ঈশ্বর।
-আরে আসুন আসুন অ্যালবার্ট
সাহেব। আপনাকে আমরা সংবর্ধনা দেব, আসুন!
অ্যালবার্ট ডানে তাকায়। বাঁয়ে তাকায়। অবশেষে বলে, ‘থুঃ’!
মেঘ বৃষ্টির উপাখ্যান
কালো। অথচ দু’চোখ মেললেই জোছনা ছড়িয়ে পড়ে ঘাসবনে। ঠোঁটের কোনায় লেগে থাকা হাসিতেই পাখি ডেকে ওঠে একসাথে। নিটোল হাতের ছোঁয়ায় নদীতে ঢেউ খেলে যায়। বাতাসের ঘ্রাণে ভেসে বেড়ায় বসন্তের ঘরবাড়ি। এমন রূপ থেকে মুক্ত হতে চেয়েছি বার বার। কিন্তু শেষমেশ ধরা পড়ে গেছি হাতেনাতেই।
একদিন আমাকে না বলেই চলে গেলে। রাগ হল। খুব। হয়তো বলতে চেয়েছিলে অনেক কিছুই। পারোনি। ভেবেছিলে, লাভ নেই কোনো। তাই...
ফিরে এলে। কোলে কাকে যেন নিয়ে। তারপর আবার। এবং আবার। এভাবে কিশোরী কখন যে বড় হয়ে যায়! টের পেলাম কই?
একদিন চোখে চোখ। বললে, কেমন আছ? বললাম, গাছেদের মতো, মেঘেদের মতো, বৃষ্টির মতো, হাওয়ার মতো, শিশিরের মতো। আর তুমি শুনে খুব হাসলে। খুব। খুব। খুব। যেন অনেক অনেক দিন পর হেসে উঠলে সজিনা ফুলের
মতো। মেঘের উপর সবচেয়ে উঁচু মেঘের মতো। আমি কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। একা একা। পথগুলো ভাঙছিল। একে একে। টুকরো টুকরো হয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল বাতাসে।
একটা চিরুনি কারখানায় কাজ পেলাম। হাম্বুর পেটানোর। সারাদিনে দেড়শো। আগুনের পাশে থেকে থেকে আগুন বেমালুম ভুলে গেলাম। একটু একটু করে।
সেদিন বাড়ি ফিরলাম। শুনলাম, আর নেই! খুব কান্না পেল। অথচ একটুও কাঁদতে পারলাম না। মনে পড়ে, ওই ঠোঁট ওই ডানার মতো ঠোঁট ওই বুক ওই পাখি ভর্তি বুক ওই চুল ওই মেঘের মতো চুল ওই হাত ওই ফাগুনভাষার হাত--সব এখন আগুনমাখা। ওই পা ওই নগ্ন পা এখন নূপুরহীন দুপুরহীন পথে
একলা একলা হেঁটে যাবে বৈতরণীর তীরে। ভাবছি ভাবছি আর ভাবছি। অথচ এক ফোঁটা জলও এল না চোখে। তবে কি যন্ত্রই হয়ে গেলাম শেষমেশ? এরকম করে কেটে গেল দিন। মাস। বছর। যুগ। একদিন দেখলাম, সব চুল সাদা। ঘর ভর্তি কচিকাঁচারা। উঠোন ছোটো হতে হতে তুলসীবেদীর থেকে আর একটু ছোটো হয়ে এল। কাঁটাতারের শরীর জুড়ে কেবল অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি। ঘাসবনে প্রোমোটারের পরিত্যক্ত বিয়ারবোতল আর
চানাচুরের প্যাকেট। পাশে বালির ঢিবি। তবু মাঝরাতে চিলেকোঠার ’পরে মেঘ করলেই গম্ভীর হয়ে যাই আজও। ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ছাদে। একা একা। চেয়ে থাকি। দেখি জোছনায় আবার ছেয়ে গেছে আমাদের ঘাসবনে। ভিজে গেছে উঠোন। চেয়ে দেখি বাবলাদের উঁচু উঁচু আমগাছগুলো। ঘাসবনে তখন রাজহাঁস। উড়ছে। ছুটছে। আর ওপাশে দাঁড়িয়ে আমার কালো মেঘ। বৃষ্টির নীচে। একা! ভীষণ একা!
ফসিল
অনেক চেষ্টা করছি, অথচ পারছি না কিছুতেই। মুখটা ভুলেই গেছি, অথচ কত-না চুম্বনের শরীর সেখানে ভেসে বেড়ায়
আজও। আর কী কী-- সে-সব ভাববার চেষ্টা শুরু করি পুনরায়। প্রথমত...দ্বিতীয়ত...তৃতীয়ত...
অনুভবের ট্রাম ঘটাং ঘটাং করে বেলাইন হয়ে পড়ে বার বার। কেউ কি চাপা পড়েছে? নিজের লাশ ছাড়া? নিজের আত্মার চিৎকার ছাড়া কেউ কি এত করুণ আর্তনাদ করতে
পারে কখনও?
নিজের প্রতি রাগ হয়। ঘৃণাও। নিজের গালেই একটা চড় কষিয়ে দিতে ইচ্ছে করে খুব। কিংবা থুতু ছেটাতেও। কিন্তু আমি যে অসহায়। কে বোঝে!
ইতিমধ্যে তাঁর সাথে দেখা হয়ে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লাল নাইটিটা এক হাতে ডান হাঁটু
পর্যন্ত তুলে সে-ই। বাপের বাড়ির গলিতে। যেমন হয় আর কি! চকচকে হাঁটু। একটু উপড়ে সেই লাল জড়ুল, আর একটু উপরে সেই লাল প্যান্টি। কী আশ্চর্য! এত দিন পর সেটাই যে তার কি মানে আছে?
অন্য হাঁটু ঢাকা। চোখে বাইকের আলো-পড়াতে আমাকে দেখতেই পায়নি সে। কিংবা আমার শিসটাই শোনেনি ঠিকঠাক। মুখটা দেখলাম। বেশ মেদ জমেছে। তবে আগের থেকে বেশ ফর্সা এখন। ডানদিকের চোয়ালে একটা দাঁত ফাঁকা। কোলে মেয়ে নিয়ে গপ্পো করছে দিব্বি।
আবার চেষ্টা করলাম। নাঃ। একদম ভুলে গেছি। পুরোনো চিঠিগুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম। পড়লাম। তাও!
সহসা দেখলাম একটা চিঠির গা-বেয়ে ছুটছে এক কিশোরী। যেমনটা আমাদের ধান খেতের আল ধরে দেখি মাঝে মাঝেই। ছুটতে ছুটতে হাতদুটি ডানা হয়ে গেল। তারপর উড়তে লাগল সে। উড়তে উড়তে হারিয়ে গেল নীলাকাশে। খুঁজলাম। এদিক-ওদিক। অনেক। অবশেষে বুঝলাম, আকাশই তাকে লুকিয়ে রেখেছে এতদিন!
এদিকে পড়ে থাকে হতাশ্বাস। সোনার ধানখেত। পাগল বাতাস। ঘাসবন। আর আলের পাশে এক জোড়া জুতো। সে-দুটোও কি লাল?
অলৌকিক নীল হাত এবং...
মোবাইলটা কানে রাখতেই ট্রেন
ঢুকে গেল। সেও। আচমকা মনে হল একটা পরিচিত হাত তার কাঁধ ছুঁয়ে গেল! মাঝে মাঝেই এমনটা হয়। কেন? ছাই থেকে কি উঠে আসে আত্মার পোশাক? গলাটা কেমন শুকিয়ে আসে তার। ঢক ঢক করে জল ঢালে। তারপর হাঁপাতে থাকে। এদিক-ওদিক চায়। কিছু দৃষ্টি তাঁর দিকেই ।
গন্তব্য এসে গেল। একটা রিক্সা ধরে বাড়ি ফেরা। আজ একটু রাত হল। ঘরে ঢুকতেই দেখে শোফায় এলিয়ে পড়েছে মানব। চোখ খোলে। হাসে।
-এত দেরি?
-হয়ে গেল। সরি।
-না না, ইটস্ ওকে!
তারপর এগিয়ে আসে। খুব খুব কাছে। ঠোঁটের আলপনা নদীর মোহনায় মোহনায়। হালকা বৃষ্টি নামে। মৃদুমন্দ মেঘও ডাকে। নৌকাও দুলে ওঠে মায়াঘেরা অনিবার্য ইশারায়। আরো আরোও!- -ওহ্ নীল!
আবার? সহসা অসহায় বোধ করে মানব। শীতে কুঁকড়ে যায় তার শরীর। উঠে পড়ে। সম্বিৎ ফেরে শারিকার। পিঠের নরম আঙুলগুলো আলগা হয়ে আসে ক্রমশ। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন। অবশেষে ভাঙন। আচমকা দরজা খোলার শব্দ। আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় মানব। কেবল নীল মোহনায় পড়ে থাকে বিপন্ন প্রজাপতির
লাশ!
ফেরা
সেখানেই ছিলাম। কতক্ষণ মনে নেই। শুধু মনে পড়ে সেই রুগ্ন বিকেলে বসে পড়লাম কবির
পরিত্যাক্ত বাড়ির উঠোনে। কয়েকটি কাগজের টুকরো নিয়ে
কেবল অসংলগ্ন নাড়াচাড়া। অন্ধকার নামছে বাদুড়ের ডানার
মতো। অদূরের স্টেশন থেকে কেবল ট্রেনের শব্দ আর কয়েক
টুকরো আলো এসে লাগে। তারই মাঝে টের পাই রাত অনেক
হল। কত? বুঝে উঠতে স্টেশনে এলাম। নাঃ! কেউ নেই এখানে। বুঝলাম রাত অনেক হয়েছে। প্ল্যাটফর্মে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। পাগল, ভিখারি কিংবা একটা হকারকেও দেখছি না। কিছুক্ষণ পরেই ট্রেন ঢুকল। উঠে পড়লাম। ট্রেন ছাড়ল। জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া আসছে। বেশ ঠাণ্ডা। যদিও এখন ঘোর বসন্ত। কামরায় আমি একা। বোধহয় আগের স্টেশনগুলিতে সকলে নেমে পড়েছে। অন্ধকার পেরিয়ে ট্রেনটি চাঁদপাড়ায় এসে থামল। কেউ উঠল না। কাউকে নামতেও দেখলাম না। আবার চলা শুরু। বিভূতিভূষণ হল্টে ট্রেনটা দাঁড়ালে মনে হল কামরায় কেউ একজন উঠেছে। ঠিক কামরার শেষ প্রান্তে। জানলা থেকে সরে এসে লোকটাকে দেখতে পারছি। শেষ প্রান্তে মাথা নীচু করে বসে আছে। ভাবলাম এদিকে তাকাবে। এই নির্জন যাত্রায় সেও আমাকে দেখে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ফাঁকা ট্রেনে নিয়ম ভেঙে একটা বিড়ি ধরিয়ে আর
একটা এগিয়ে দেবে আমার দিকে, আর আমি অমায়িক আন্তরিকতায়
সেটিকে ফিরিয়ে দেব। না। এরকম আদৌ হয়নি। লোকটি আমার উপস্থিতিতে অত্যন্ত বিরক্ত কি না তাও বুঝতে পারছি না। সিকদারপল্লি এসে ট্রেনটা ডানদিকে প্রকাণ্ড বাঁক
নিল। এই সময় কিছুটা শ্লথ হয়ে আসে। চারিদিকের বাড়িগুলো আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ট্রেনটা এবার স্টেশনে ঢুকে পড়ছে ক্রমশ। ঠিক করলাম, রানিং-এ নামব। নামলামও। আর নেমেই হাঁটা দিয়েছি। অমনি দাঁড়ালাম। ভাবলাম, একবার দেখি সেই লোকটিকে। ধীরে ধীরে ট্রেন থামল। কিন্তু কেউ নামল না। সেই লোকটি এমনকি গাড়ির চালক কিংবা গার্ডও!
বিপরীত দিক থেকে নামলেও-তো চোখে পড়বে। অগত্যা ফিরলাম। গ্যারেজের সামনে আমার সাইকেলটা পড়ে আছে একা।
দরজা বন্ধ। সাইকেলটা তুলে নিয়ে এগোই। স্টেশন রোডে এই সময় কুকুরদের খুব উল্লাস। সারাদিন গাড়িঘোড়া-মানুষের চাপে তিতিবিরক্ত প্রাণীগুলো এবারে একটু
শান্তির খোঁজে একে একে নেমে আসে পথে। একটু প্রেম আর একটু অপ্রেমে মেতে ওঠে। রাস্তাটা এখন তাদের। তারাই রাজা। অন্তত এই সময়ের। কিন্তু আজ তারাও নেই। ফাঁকা রাস্তায় কয়েকটি ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়েছে। রেলগেট পার হয়ে বাড়ির রাস্তা
ধরি। সাইকেল যেন জেট
প্লেনের বেগে ছুটে চলেছে। অবশেষে এসে পৌঁছলাম বাড়ির সামনে। সেই পুরোনো বাড়ি।
দোতলা। বাবা বানিয়ে ছিলেন। বাইরের ঘোরানো সিঁড়িটার উপর জ্বেলে থাকা বাতিটা
আজ নেভানো। বাড়ির লোকগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। মনে হচ্ছে এ-বাড়িতে আজ বহুদিন পর এসেছি, আর কেমন অদ্ভুত লতাপাতায় ভরে উঠেছে
চতুর্দিক! ডাকলাম। কিন্তু কোনো শব্দ হল না। আশ্চর্য!
Comments
Post a Comment