Skip to main content

ছোটগল্প ।। বেড়াল ।। অমিতকুমার বিশ্বাস ।।

'বেড়াল' গল্পটি 'রাত্রির হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়োপোকা' থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রথম প্রকাশিত হয় 'দ্বৈপায়ন’-এ, ২০০-এ'ইতিকথা এখন' (ISSN:2394-1456)-এর বইমেলা-২০১৫ সংখ্যাটিতে বিশিষ্ট কবি বিভাস রায়চৌধুরী লিখেছেন,"'বেড়াল' গল্পটিকে অণুগল্প বলব। অণুগল্প কি কেবলই একটি আকার? আমি শুধু বলতে চাই এত টুকু অতিরিক্ত নেই বলেই এই গল্পটি দীর্ঘস্থায়ী কীর্তি। পাঠককে এই গল্পটি মন দিয়ে পড়তে অনুরোধ করছি।" 



ছোটগল্প 
বেড়াল

অমিতকুমার বিশ্বাস


                 একটা মরাকান্না ফাঁকফোঁকড় সম্বল করে  ঘরের দেওয়াল চুঁইয়ে পড়ছে । এ কান্না কিসের? এত করুণই-বা কেন? শ্যামলী আত্মঘাতী হলে তার মা এমনই শেষবার কেঁদেছিল  একমাত্র মেয়েটা ওই শীতের রাতে উঠানের চালতা  গাছটাতে অভাবে ঝুলে থাকবে--তার মা ভাবতেই পারেনি ।
               আধঘুম থেকে বিছানায় উঠে বসে উৎসবহাতের কাছের  চাদরটা কোনওমতে  গায়ে জড়িয়ে ঘরের মেঝেতে দাঁড়ায় তারপর কি এক অনিবার্য ডাকে সাড়া পেয়ে দরজার দিকে এগোয়দরজা পেরিয়ে চিলেকোঠা, চিলেকোঠা পেরিয়ে উন্মুক্ত ছাদ ছাদে আসতেই সে অনুভব করে কান্নাটা তাঁর শরীরের সবকটা রোম খাঁড়া  করে দিয়েছে ।
              ভোর চারটে কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে আবছা চাঁদের আলো সদ্য সন্তান  হারানো মায়ের ধুমায়মান চোখের মতো কুয়াশা থেকে বিন্দু বিন্দু জল অদ্ভুত এক শব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ছে মৃদু ,অথচ স্পষ্ট পাতা ,ডাল বা নীড়ে জমা এ জল মনে হয় এ ক্রন্দসী এক গোপন অভিসন্ধিতে মত্ত --এ তারই ফিসফিসানি এছাড়া  পৃথিবীটা ঘুমিয়েই মানুষজন,গাছপালা, পশুপাখি--সব। এ অন্য পৃথিবী অন্য কেউ । জন্ম থেকেই গম্ভীর হয়ে আছে আর এই নীরবতা ভঙ্গ করে  কে কাঁদে? শ্যামলীর মা রাতের অন্ধকারে পথে বসেই মাঝে-মধ্যে হাউমাউ করে কাঁদে । আবার হাসে । সেটা হাসি না কান্না তা বোঝা দায় সেও তো ক'মাস হল চোখ বুজেছে ! তবে?
              ছাদের  কার্নিশে দাঁড়িয়ে অদূরস্থিত ল্যাম্পপোস্টের ধ্যাবড়ানো আলোর নীচে চোখ রাখে উৎসব পরপর ক'টা টালির বাড়ি কুয়াশার পিছনে অস্পষ্ট । সেখান থেকেই। সারাদিন মাইক,উলু-শঙ্খধ্বনি, ভিডিও---তারপর ঘুম। চরাচর ঘুমিয়ে
               ঘুমিয়ে থাকে সোমা-রুমাভোররাতে ওরা যেন বেশি ঘুমাতে ভালোবাসে ।কেউ জাগালে চটে যায়। ভীষণ উৎসবের আবার শোওয়া খারাপ ঘুমের ঘোরে এলোপাথারি হাত-পা ছোঁড়ে খবরটা ফাস হয়ে যায় শুনে তো দু'বোন হেসেই খুন ।উৎসব খুব লজ্জা পায়। এক হপ্তা ওবাড়ি মুখো হয়না মুদীখানার দোকান থেকে নগদ কুড়ি টাকা দিয়ে একটা  চটের বস্তা কিনে আনে, তাতে কোমর পর্যন্ত  ঢুকিয়ে  রাতের পর রাত শুয়ে থাকে,তবু বদ অভ্যাস কিছুতেই যায়না আজও কি তারা ঘুমিয়ে?ঘোরের মধ্যে?
              একটা  ট্যাক্সি স্টার্টের শব্দ। কান্নাটা এবারে আরোও তীব্র, তীক্ষ্ণ ।কিছুটা সমবেততারই মধ্যে  একটা করুণ কন্ঠের আঁচড়ে ফালাফাল হয়ে  যাচ্ছে কুয়াশার হৃদয়। এ কান্না সোমার কাঁদবেই তো রুমা যে চলে যায় ।মা মারা যাবার পর সেই তো তাকে সন্তানের মতো আগলে রেখেছে এমন কি উৎসবকেও ।হাতে হাত রেখে উৎসবকে কথা দিয়েছিল,বোনকে সে তাঁর হাতেই তুলে দেবে ।
              একটা নারকীয় চিৎকার করে ট্যাক্সিটা কান্না ও উলু-শঙ্খধ্বনিকে পিছনে ফেলে অন্য জগতে অদৃশ্য হয়ে যায় । ম্যাজিক ! শব্দটার ক্রম অবলুপ্তির পরও নিষ্পলক চোখে এক ফোঁটাও জল এল উঁকি দিলনা ।পাথুরে চোখ ।পাথুরে হৃদয় ।পাথুরে শরীর । তবু সেই পাথরের গোপন ফাটল দিয়ে বিষাদের বারিপাত নৈঃশব্দ্যের ঝর্ণাধারায় ছড়িয়ে পড়ে পরিমন্ডলের আনাচে-কানাচে ।একটা ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে ভেসে যায় স্রোতে,একটা অভিমানী প্রণয়মুখর তলোয়ার  মুহূর্তেই দু'ফালি করে পৃথিবীটাকে ,একটা পথ যেতে যেতে হঠাৎ কি এক নিষ্ঠুরতায় থমকে দাঁড়ায়,তারপর একটু বাঁক নিয়ে পথিককে সহসা এক চরম  শূন্য ছায়াতলে রেখে অদৃশ্য  হয়ে যায় কিছুটা চোখরাঙানী ,কিছুটা অহং এর লড়াই,কিছুটা ভুলবোঝাবুঝি । প্রতিটা শব্দ যেন পিয়ানোর চাবির মতো সাজানোকে বাজায় ? এত স্পর্ধা কার ? ভিতরটা তোলপাড় হয়ে যায় উৎসবের ।দু'হাতে কান চেপে সে একটা অস্ফূট আর্তনাদ করে,"আঃ"!
                                   দুই
              দরজা বন্ধ করে ঘরে আসে উৎসব আলো জ্বালে ।চোখ ধাঁধিয়ে যায় ।দু'হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢাকবার   চেষ্টা করেযারা অন্ধকারে অভ্যস্ত তাদের ঠিক আলো  সহ্য  হয়না ।একটা পলায়নবাদী প্রবণতা সংক্রামক রোগের মতো আঁকড়ে ধরে । মুখ থেকে আস্তে আস্তে হাত সরায় উৎসব বিছানায় আসে বালিশে মাথা রাখতেই অবাধ্য সৈনিকের মতো  স্মৃতি ঢুকে পড়ে করোটীতে সহসা কেঁপে  ওঠে উৎসব ।চোখ বন্ধ করে। ঠোঁট কাঁপে বিষাদ সেখানে একটা দৃঢ় চুম্বন রেখে গেছে । কী ভাবছে উৎসব? পালাবার কথা? হ্যাঁ ,সেদিন পালিয়ে গেলে আজ হয়তো প্রেমের মানেটাই অন্যরকম হত
               কান্নাটা প্রায় মুছে এসেছে পলেস্তারা খসা দেওয়ালের দিকে তাকায় উৎসব একটা মাকড়ষা কি সন্তর্পণে জাল বুনে চলে সেখানেকেউ টের পায় না । একটু পরেই আর একটা উৎসব সেখানে ধরা পরবে। লাফাবে-ঝাঁপাবে বোবাকালা ছেলের মতো শুধুই গোঙাবে ।
              হঠাৎ একটা বেড়াল ধপ্ করে মেঝেতে লাফ দিয়ে পড়ে । ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে উৎসবমুখতুলে এদিক-সেদিক চাওয়ার পর  বেড়ালটি ডেকে ওঠে,"মিয়াও" সমস্ত ঘরটা যেন কেঁপে ওঠে ।আশ্চর্য ! এরকম  ভাবেই কিছু আগে কে যেন কাঁদছিল !ছাইছাইরঙা বেড়ালটির শুকনো মুখের দিকে তাকানো যায়না । চোখ  দুটো ঈষৎ সিক্ত। সেখানে অশ্রু রেখা স্পষ্টবেড়ালও কাঁদে অভিমানে সারাটাদিন কচুবন, ছেঁচিঘাট, ননিতলা  একাকী ঘুরে বেড়িয়েছেমালকিন চলে যায় যে !আর আসবেনা কখনও
            অন্য দিন হলে দৃশ্যটি হয়তো অন্যরকম হততড়াক করে লাফিয়ে উঠে দরজার হাক নিয়ে বেড়ালটিকে মারতে যেত উৎসব পিছন পিছন ছুটত । কচুবন,ছেঁচিঘাট,ননিতলা পেরিয়ে বাড়ি পর্যন্ত যেতঅমনি ঘর থেকে ছুটে আসতো বেড়ালের মালকিন। আর বেঁধে যেত ঝগড়া। তুমুল। আড়ি হতপাক্কা তিনদিন কথা বন্ধ ।
               উৎসবের মুখে আর কোনওরকম আক্রমণের অভিব্যক্তি নেই ।ভাবলেশহীন চোখে বেড়ালের শুকনো মুখের দিকে চেয়ে থাকে ।বেড়ালটি এবারে এক লাফ মেরে বিছানায় ওঠে আবার ডাকে,"মিয়াও"! উৎসব কাত হয়ে শোয় ।বেড়ালটি বুকের কাছে আসেচাদরের উপর দিয়ে তার  নরম তুলতুলে মুখ উৎসবের বুকে ঘষতে থাকে । তারপর হাত, পা, লেজ এক জায়গায় করে অমায়িক ভঙ্গীমায় শুয়ে পড়ে ।উৎসব হাও দিয়ে বেড়ালটিকে বুকের সাথে মৃদু চেপে ধরে ।সামনের দেওয়ালে তাকায় ।দেওয়ালটা ক্রমশ এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আসে কাঁপে । উৎসবের দু'গাল বেয়ে মুক্তোর মতো জলধারা নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ে


Comments

Popular posts from this blog

ছোটগল্প ।। ভূত , ভগবান এবং...

গল্পটি অচেনা যাত্রী -তে প্রকাশিত।  ছোটগল্প  ভূত, ভগবান এবং ... অমিতকুমার বিশ্বাস                       দুর্গানগর ছাড়তেই অন্ধকার নেমে এল। ভয়ে সিঁটিয়ে নুনি । ভাবছে কেউ চটকে খাবে। খুবলে খাবে। ঘামছে। দর দর করে। হাতের রুমালটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না সে । নাকটা দিব্বি   ফুলে যাচ্ছে। এবার হয়তো মাথাঘুরে পড়ে যাবে ...                       সবাইকে চমকে দিয়ে আলো এল কামরায় । মুখগুলো ভেসে ওঠে। সব। একে একে।    পাশের কাঁচাপাকা দাড়িমুখো , পিছনের টাকমাথাওয়ালা। এরকম আরও । লোকগুলো কত কাছে আবার কতদূরে। একদম ছবির মতো দেখতে পাচ্ছে সে । ছবিটা দেখতে দেখতে শান্ত হল মন। পরিচিত ছবি। একজন শুভানুধ্যায়ী ছবি থেকে উঠে এসে বল লেন , দিদিভাই লেডিসে আসতে পারেন কিন্তু ! মনে মনে নুনি বলে উঠল , আর লেডিস ! এদিকে ঘাম শুকিয়ে এসেছে। বুকের ধড়ফড়ানিও । থোকায় থোয়ায় ঝুলে থাকা একঘেয়ে আম আদমি। এইসব কার্বাইটে পরিপক্ক আম আদমির গন্ধ মাখতে মাখেতে নুনি চলে এসেছে বনগাঁ য় ।                         রাত । নুনি শুয়ে আছে বিছানায় । সবে রান্নাবানা খাওয়াদাওয়া সারল। ঘরে জিরো জ্বলছে। পাশে

ছোটগল্প ।। দৃষ্টি ।।

‘দৃষ্টি’ গল্পটি   ' রাত্রির হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়োপোকা '   থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রথম প্রকাশিত হয়   ' অচেনা যাত্রী’-তে - এ ,   ২০ ১৩ -এ।   ' ইতিকথা এখন ' (ISSN: 2394-1456)-এর বইমেলা-২০১৫ সংখ্যাটিতে বিশিষ্ট কবি বিভাস রায়চৌধুরী লিখেছেন ,"' সাপ’ ও ‘দৃষ্টি’ গল্পের মধ্যেও ভাস্কর্য মূলক নির্মিতির ছাপ টের পাই। বোঝা যায়, গল্পের বিষয় শুধু নয়, গল্পের আঙ্গিক নিয়েও অমিত চর্চা করতে চায়।”   দৃষ্টি অমিতকুমার বিশ্বাস               পথটা সরু । দু ' পাশে সারি সারি গাছ । ঘন। একটা বিন্দুতে এসে মিসেছে । আর সেদিকেই দৃষ্টি । পথে নয় , পথের উপর হেঁটে যাওয়া এক নদীর উপর । নদী ? হ্যাঁ নদী।রূপসা । সে - তো নদীর - ই নাম । নদীর মতোই ঢেউ খেলে যায় ।ছোঁয়া   লাগলেই কাঁটা দেয় ।পবিত্র হয় শরীর । নদীতেই তো পাপমোচন । শাপমোচনও ।            রূপসা এবারে ছোটে। প্রকান্ড ঢেউ । মাটি কাঁপে। প্রথমে মৃদু । পরে বাড়ে ।বেড়ে যায় । ক্রমশ । এ এক মানানসই   চলন । সম্মুখে সমুদ্র । ঘাসবনের ।এখানেই সঙ্গম । সুতীব্র। রূপসা এবারে পিছনে তাকায়। হরিণীর মতো । বঙ্কিম গ্রীবা । হেলানো নিতম্ব। অম

ছোটগল্প ।। রবীন্দ্রনাথ ।। অমিতকুমার বিশ্বাস ।।

'রবীন্দ্রনাথ'  গল্পটি 'রাত্রির হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়োপোকা' থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রথম প্রকাশিত হয় 'ঋতমঞ্জরী'-তে, ২০০৯-এ, সেখানে দ্বিতীয় পদ্যটি অন্যরকম ছিল, আর তৃতীয় পরবটি ছিল না। 'ইতিকথা এখন' (ISSN:2394-1456)-এর বইমেলা-২০১৫ সংখ্যাটিতে বিশিষ্ট কবি বিভাস রায়চৌধুরী লিখেছেন,"'রবীন্দ্রনাথ' গল্পে শ্লেষরসের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে অমিত। সময় এখানে যথার্থ নাটকীয়। অনেক কবিতায় কাহিনি যেমন বৃহৎ কিছুকে নির্দেশ করে, 'রবীন্দ্রনাথ' গল্পেও তেমনই প্রতীক ভেঙে জীবন্ত হয়ে উঠতে চাইছে লেখকের যন্ত্রণা, নিষ্ঠুর সমাজসত্য।"  রবীন্দ্রনাথ অমিতকুমার বিশ্বাস               তিনটি রাস্তা তিনদিকে ছুটে চলেছে । ত্রিমাথায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ । শুভ্র মর্মর মূর্তি । সেই সাত দশক ধরে দন্ডায়মান এক বৃদ্ধ । চতুর্দিকে কত পরিবর্তন ।বৃদ্ধেরও হয়েছে ।তবে যা হয়েছে তা সবই নেতিবাচক । সাদাচুল , সাদাদাড়ি - এখন সবই হলদেটে ।অনেক কিছুই সয়েছে মূর্তিটি । প্রবল বন্যা , আয়লা ইত্যাদি ।সেদিনের ঝড়ে মূর্তিটি প্রায় ভেঙেই যাচ্ছিল । প্রকান্ড ডালটা সামনেই পড়ল ।বৃদ্ধ তবু নির্বিকার ।তা