Skip to main content

ছোটগল্প ।। রবীন্দ্রনাথ ।। অমিতকুমার বিশ্বাস ।।

'রবীন্দ্রনাথ'  গল্পটি 'রাত্রির হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়োপোকা' থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রথম প্রকাশিত হয় 'ঋতমঞ্জরী'-তে, ২০০৯-এ, সেখানে দ্বিতীয় পদ্যটি অন্যরকম ছিল, আর তৃতীয় পরবটি ছিল না। 'ইতিকথা এখন' (ISSN:2394-1456)-এর বইমেলা-২০১৫ সংখ্যাটিতে বিশিষ্ট কবি বিভাস রায়চৌধুরী লিখেছেন,"'রবীন্দ্রনাথ' গল্পে শ্লেষরসের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে অমিত। সময় এখানে যথার্থ নাটকীয়। অনেক কবিতায় কাহিনি যেমন বৃহৎ কিছুকে নির্দেশ করে, 'রবীন্দ্রনাথ' গল্পেও তেমনই প্রতীক ভেঙে জীবন্ত হয়ে উঠতে চাইছে লেখকের যন্ত্রণা, নিষ্ঠুর সমাজসত্য।" 




রবীন্দ্রনাথ
অমিতকুমার বিশ্বাস


              তিনটি রাস্তা তিনদিকে ছুটে চলেছেত্রিমাথায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ শুভ্র মর্মর মূর্তি সেই সাত দশক ধরে দন্ডায়মান এক বৃদ্ধ চতুর্দিকে কত পরিবর্তন ।বৃদ্ধেরও হয়েছে ।তবে যা হয়েছে তা সবই নেতিবাচক সাদাচুল,সাদাদাড়ি -এখন সবই হলদেটে ।অনেক কিছুই সয়েছে মূর্তিটি প্রবল বন্যা,আয়লা ইত্যাদি ।সেদিনের ঝড়ে মূর্তিটি প্রায় ভেঙেই যাচ্ছিল প্রকান্ড ডালটা সামনেই পড়ল ।বৃদ্ধ তবু নির্বিকার ।তাকে যে দাঁড়াতেই হবে মেরুদন্ডী হয়ে।

              আগামীকাল মূর্তিটি ভাঙা হবেপ্রকান্ড হাতুড়ির আঘাতে টুকরো টুকরো হবে রবীন্দ্রনাথের হৃদয় তারপর লাশটাকে রিক্সাভ্যানে তুলে টানতে টানতে নিয়ে যাবে নর্দমার ওপাশে,যেখানে সে বোবাকালা  হয়ে শুয়ে থাকবে সিধুপাগলের পাশে
                 সকালেই বড়োবাবু মত দিলেন,"সভ্যতা এগোচ্ছেরাস্তার মোড়ে এভাবে রবীন্দ্রনাথের ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে আছে ?যতসব নন-ইনটেলেকচুয়াল আউটডেটেড  কনসেপ্ট "এদিকে ছোটবাবু বললেন,"বুড়ো হয়েছে,বৃদ্ধাবাসে থাকতার বদলে ওখানে কচিকাঁচারা খেলাধুলা করুক।" রবীন্দ্রনগরে গত কয়েকদিন ধরে এইসব সাধুবচন হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছিল ।এর মধ্যে কিছু পাগল কবিভক্ত কাঁদল রাস্তায় শুয়ে থাকল পুলিশ এল নিয়ে গেল ।তারপর সেকি প্যাদানী! বাবাগো মাগো চিৎকার অতঃপর সব চুপ
                সামনেই পরেশের চায়ের  দোকান ।কথায় কথায় সে বলে উঠল,"ইদানিং তো হোর্ডিং এর দৌলতে বুড়োদাদুর মুখই দেখা যায়না ।তার চেয়ে বরং ভেঙে ফেলাই ভালোওখানে আরো বড়ো একটা হোর্ডিং লাগান যাবে ।সেই পয়সায় পার্ক হবে ইয়াং ছেলেপুলে কাজ পাবে হেঃ হেঃ -যুগে রবীন্দ্রনাথ সিকির মতোই অচল আজকাল ভিখারিকে দিলেও ভিখারি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে ,'বাবু আপনে রাহেন,বিপদি-আপদি কামে আসবে !' বোঝো ঠ্যালা!"
  "ঠিক বোলিচো পোরে" হলুদ হয়ে আসা অবশিষ্ট দন্তগুলি বিকশিত করে চায়ের কাপটা  কাঠের বেঞ্চে বার দুই টোকা মেরে সজোরে বলে উঠল নেপাল খুড়ো,"কি ছিল ওর? ছিলতো এট্টা নোবিল,তাও সেইডারে কিরা গ্যাঁড়া দিছে হেঃ হেঃ ।ওর চেয়ে আমাগো মদনা ছেলিটা কী সুন্দর কবিতা নেকে বলোদিন ! শোন--
                                  টিপকল
                            চরণ তোমার তলে
                            হাত দু'খানি কলে
                             চাপ দাও হাতলে
                           চরণ ভিজে গেল জলে ।"
বাঃ বাঃ অসাধারণ!" পরেশ চা ছাঁকতে ছাঁকতে বলে ঊঠল, "খুড়ো ,মদনার আর একখানা শোনো-
                                       খেলা

                   হারমোনিয়াম সারারাত ডেকেছে নাক,
                   রামের বোতলে মহাভারত আর একতা কাপুর
                   খেলছে হা-ডু-ডু।
                   এদিকে চুরি গেছে সানি লিওনের অন্তর্বাস
                   যমুনা তীরে কাঁদছে সে হাপুস নয়নে ।
                  এদিকে বড়োবাবুর কপালে ভাজ,
                   হারমোনিয়াম সারারাত ডেকেছে নাক ।

                   অক্টোপাস আসপ্রিয়াও পর্নোগ্রাফিতে নামার আগে
                  সেরে নিম গঙ্গাস্নান ওপাড়ার রুমকী বৌদির সঙ্গে ।
                  মেয়েকে বেঁচে আইফোনের নীল ছবিতে রেখেছে চোখ
                  এক সুখি দম্পতি। ভগবানের পিছনে বাঁশ
                  দিয়ে পুজোর ক'দিন কেলাচ্ছে দাত কুমোরটুলির
                  দুই কারিগড় ।এর মধ্যে ফেসবুকের দেওয়ালে
                  হিসি করে দিয়ে গেল্ বেপাড়ার ছেলেগুলো !
                  এ দেখে বড়োবাবুর কপালে ভাজ
                 হারমোনিয়াম সারারাত ডেকেছে নাক ।

সাব্বাস!! এইডা হইলো গিয়া কবিতা ।আর ওই রবি যে কীসব বস্তাপচা নিকে সাহেবগো কাছ থিকা নোবিলডা গ্যাঁড়াইয়া নিল, সেইডারে ঠাহোর কোরতি পারিনে বাপুবাপের জোমিদারি থাকলি ওরম নিকা যায় ।বোজ্জো! আর মোনি রাখবা, গ্যাঁড়ার মাল গ্যাঁড়ায়-ই যায়।"
                                          
                                   দুই

                  মধ্যরাতল্যম্পপোস্টের ছানিপড়া আলোর কুয়াশা ভেদ করে কারা ছুটে আসছে এদিকেই ?একটা শিশু মুখে আর্তনাদ বাঁচাও। বাঁচাও। পিছনে খানবিশেক লিকলিকে নেড়ি কুকুর ক্ষুধায় উন্মাদশিশুটির এক হাতে খাবার জাতীয় কিছু ।অন্যহাতে রক্তের প্রলেপ নরখাদকগুলোর আক্রমণে ছুটতে ছুটতে শিশুটি রবীন্দ্রনাথের কাছে এল পিশাচগুলোও।সেগুলো ছোবল মারতে না মারতেই শিশুটি মূর্তিটির ওপর চেপে বসল একেবারে কাঁধেচড়েই জাপ্টে ধরল রবীন্দ্রনাথকে । জংলী শ্বাপদ্গুলো নীচে ঘোরাফেরা করছিল,আর মাঝে মধ্যে স্থির হয়ে তাকাচ্ছিল কিছুক্ষণ, ঠিক যেভাবে ধর্ষকামী নেশাখোরেরা ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্বমুহূর্তে অদ্ভুত এক পৈশাচিক ভঙ্গিমায় মৌন হয়ে যায় আর তাদের চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসে আগুনের হলকা,জিভ্ দিয়ে লালাঝরে অবিরত ।হঠাৎ রাক্ষসগুলো সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে,আর সেই বিকট শব্দে যেন চৌচির হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের হৃদয় কালো হাতের দেশ থেকে অপদেবতারা এসেছে ছোট্ট রাজপুত্রকে লুঠ করতে রবীন্দ্রনাথ কি পারবেনা রক্ষা করতে  তাঁর কোমল হাত দুটিকে? পারবেনা এভাবেই তাকে কাঁধে ধরে রাখতে?
                 পরনে একটা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট ছেঁড়াই ছিল। পিশাচগুলো আরো ছিঁড়ে দিয়েছে পা থেকে খুবলে নিয়েছে মাংস হাত থেকেও খালি গা সেখানেও কামড়ের দাগ স্পষ্ট। টপ্ টপ্ করে রক্ত পড়ছে ভয়ে মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছেনা।দেহ কালিমালিপ্ত।অস্তিচর্মসার চুল উষ্কখুষ্ক ।মুখটা শুকিয়ে একসা । চোখদুটো নীল।কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ঠক্ ঠক্  করে কাঁপছে  সমস্ত শরীর ।কয়েক মুহূর্তে মূর্তিটি লাল! রক্ত গড়িয়ে নীচে পড়ছে,আর পিশাচগুলি চটপট চেটেপুটে খাচ্ছে ।সে কী ভয়ঙ্কর আহারযুদ্ধ ! শিশুটি আরোও  ভয় পায় কাঁপে ।শীতের থেকেও বেশি মৃত্যুকে মুখোমুখি দেখতে পেয়ে গলা শুকিয়ে যায়মূর্তিটিকে  বড় বেশি আপন মনে করে আরোও জড়িয়ে ধরে, সন্তান যেভাবে ধরে তাঁর মমতাময়ী  মাকে।
                   না ,তাঁর মা নেই ।বাবাও।পথেই জন্মেছিল একদিন । হয়তো পথেই হারিয়েযাবে একদিন ।একদিন জ্ঞান হবার পর নিজেকে আবিস্কার করল হরিপদ-র চায়ের দোকানে ।একদিন হাত থেকে গ্লাস পড়ে যায় ।মুহূর্তেই চৌচির ।তৎক্ষণাৎ হরিপদ হাতের গরম চা ছুঁড়ে মারে মুখে ।
              সবেমাত্র চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল ভাবতেই চোখ খুলে যায় ,দেখে,সেখানেই আছে। নীচে পিশাচগুলি শুয়ে একটা টুক করে একচোখ খুলে দেখে নেয় হাল-হকিকৎ তারপর বন্ধ। পাকা অভিনেতা। খেলা জমে ওঠে শিশুটিরও চোখ বন্ধ হয়ে আসে পুনরায় ।আর সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে ওঠে হরিপদ- চায়ের দোকান থেকে পালানোর দৃশ্যপালাতে পালাতে একদিন কাগজ-কুড়ানিদের দলে ।তারপর ভাড়াটে ভিখারির ছদ্মবেশ ।তারপর ইটভাঁটায়বিহারিলালের ধাবায় ট্রেনে ট্রেনে জুতোপালিশ,টয়লেট সাফ করা। তারপর? তারপর? তারপর? কাজ আসে কাজ যায়।সে নিজেই ভুলে যায় নিজের নামঠিকানা। পরিচয় এক কক্ষচ্যূত গ্রহাণুপুঞ্জের মতো মহাশূন্যে ভেসে বেড়ায় অবিরত। সুখ নাই। সুখ নাই সুখ নাই কোথাও।
                                   তিন
               ভোর হল রবির রক্তিম আলোয় ভরে উঠল এ ক্রন্দসী ভরে উঠল কূজনে একদল ভীষণ কালোমাখা লোক সহসা ঘিরে ধরল রবীন্দ্রনাথকে, যেভাবে সুপারী কিলারেরা ঘিরে ধরে তাদের  নিরীহ শিকারকে ।একে একে সকলে অস্ত্র তুলে ধরে ।এইবার.. এইবার...এইবার শেষ.... একেবারে.....
এমন সময়  একজন কালোমাখা লোক বলে উঠল,"এত রক্ত কেন?"



Comments

Popular posts from this blog

ছোটগল্প ।। ভূত , ভগবান এবং...

গল্পটি অচেনা যাত্রী -তে প্রকাশিত।  ছোটগল্প  ভূত, ভগবান এবং ... অমিতকুমার বিশ্বাস                       দুর্গানগর ছাড়তেই অন্ধকার নেমে এল। ভয়ে সিঁটিয়ে নুনি । ভাবছে কেউ চটকে খাবে। খুবলে খাবে। ঘামছে। দর দর করে। হাতের রুমালটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না সে । নাকটা দিব্বি   ফুলে যাচ্ছে। এবার হয়তো মাথাঘুরে পড়ে যাবে ...                       সবাইকে চমকে দিয়ে আলো এল কামরায় । মুখগুলো ভেসে ওঠে। সব। একে একে।    পাশের কাঁচাপাকা দাড়িমুখো , পিছনের টাকমাথাওয়ালা। এরকম আরও । লোকগুলো কত কাছে আবার কতদূরে। একদম ছবির মতো দেখতে পাচ্ছে সে । ছবিটা দেখতে দেখতে শান্ত হল মন। পরিচিত ছবি। একজন শুভানুধ্যায়ী ছবি থেকে উঠে এসে বল লেন , দিদিভাই লেডিসে আসতে পারেন কিন্তু ! মনে মনে নুনি বলে উঠল , আর লেডিস ! এদিকে ঘাম শুকিয়ে এসেছে। বুকের ধড়ফড়ানিও । থোকায় থোয়ায় ঝুলে থাকা একঘেয়ে আম আদমি। এইসব কার্বাইটে পরিপক্ক আম আদমির গন্ধ মাখতে মাখেতে নুনি চলে এসেছে বনগাঁ য় ।                         রাত । নুনি শুয়ে আছে বিছানায় । সবে রান্নাবানা খাওয়াদাওয়া সারল। ঘরে জিরো জ্বলছে। পাশে

ছোটগল্প ।। দৃষ্টি ।।

‘দৃষ্টি’ গল্পটি   ' রাত্রির হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়োপোকা '   থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রথম প্রকাশিত হয়   ' অচেনা যাত্রী’-তে - এ ,   ২০ ১৩ -এ।   ' ইতিকথা এখন ' (ISSN: 2394-1456)-এর বইমেলা-২০১৫ সংখ্যাটিতে বিশিষ্ট কবি বিভাস রায়চৌধুরী লিখেছেন ,"' সাপ’ ও ‘দৃষ্টি’ গল্পের মধ্যেও ভাস্কর্য মূলক নির্মিতির ছাপ টের পাই। বোঝা যায়, গল্পের বিষয় শুধু নয়, গল্পের আঙ্গিক নিয়েও অমিত চর্চা করতে চায়।”   দৃষ্টি অমিতকুমার বিশ্বাস               পথটা সরু । দু ' পাশে সারি সারি গাছ । ঘন। একটা বিন্দুতে এসে মিসেছে । আর সেদিকেই দৃষ্টি । পথে নয় , পথের উপর হেঁটে যাওয়া এক নদীর উপর । নদী ? হ্যাঁ নদী।রূপসা । সে - তো নদীর - ই নাম । নদীর মতোই ঢেউ খেলে যায় ।ছোঁয়া   লাগলেই কাঁটা দেয় ।পবিত্র হয় শরীর । নদীতেই তো পাপমোচন । শাপমোচনও ।            রূপসা এবারে ছোটে। প্রকান্ড ঢেউ । মাটি কাঁপে। প্রথমে মৃদু । পরে বাড়ে ।বেড়ে যায় । ক্রমশ । এ এক মানানসই   চলন । সম্মুখে সমুদ্র । ঘাসবনের ।এখানেই সঙ্গম । সুতীব্র। রূপসা এবারে পিছনে তাকায়। হরিণীর মতো । বঙ্কিম গ্রীবা । হেলানো নিতম্ব। অম